শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামে আজ নেমে এসেছে শোকের ছায়া। লাশবাহী গাড়ি গ্রামের প্রবেশমুখে ঢুকতেই হুহু করে কেঁদে ওঠে চারপাশ।
মায়ের কোলে গাড়ির জানালার পাশে আছে ছোট্ট দুই শিশু আব্দুল্লাহ (৫) ও সুরাইয়া (৩)। তারা জানে না, জানালার ওপাশে তাদের প্রিয় বাবা আবুল কালাম আজাদ (৩৫) নিথর দেহে শুয়ে আছেন।
মায়ের চোখের জল দেখে শিশুরা নিষ্পাপ কণ্ঠে বলে ওঠে, মা, তুমি কান্না কোরো না, বাবা ঘুমাচ্ছে। এই কথায় বুক ভেঙে যায় মা আইরিন আক্তার প্রিয়ার।
তিনি কান্না থামাতে না পেরে বলেন, আমার সন্তানরা এখনো বুঝতে পারে না, তাদের বাবা আর ফিরবে না। ওরা বলে—‘বাবা ঘুমাচ্ছে মা, তুমি কান্না কোরো না।’ আমি কিভাবে ওদের বোঝাই, ওদের বাবা আর কোনোদিন জাগবে না।
রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের একটি পিলার থেকে ভারী ধাতব যন্ত্রাংশ (বিয়ারিং প্যাড) খুলে নিচে পড়ে যায়। সেটি গিয়ে লাগে তরুণ ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের মাথায়। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডে থেমে যায় এক সুখী সংসারের হাসি-খুশি জীবন। স্ত্রীর চোখে আজ শুধু অনন্ত শূন্যতা।
ভেঙে পড়া স্ত্রী আইরিন আক্তার প্রিয়া বলেন, রোববার দুপুরে জানতে পারি, বাচ্চাদের বাবা দুর্ঘটনায় পড়েছে। মুহূর্তেই মনে হলো, পৃথিবী থেমে গেছে। এখনো বাচ্চারা খুঁজে বেড়ায়—‘ড্যাডি কোথায়, ড্যাডি আমার জন্য চকোলেট আনবে।’ আমি কাকে বলব, ড্যাডি আর কোনোদিন ফিরবে না। ওদের ভবিষ্যৎ কী হবে, ওরা কীভাবে চলবে, কীভাবে থাকবে। কে করবে ওদের দেখাশুনা। আমরা তো এতিম হয়ে গেলাম। ওদের বাবার পূর্ণতা কে দিবে, ওদের বাবা তো আর আসবে না। আমার ছেলে কোন দিন বাবার বুক ছাড়া ঘুম আসেনি।
তিনি আরো বলেন, আমার স্বামী আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল। এখন আমি আর আমার দুই সন্তান পুরোপুরি দিশেহারা। সরকারের কাছে আবেদন—আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎটা যেন অন্ধকারে না হারায়, তাদের পাশে দাঁড়ান।
আমাদের অভিভাবক ছিল সে-ই। এখন আমার দুই সন্তান এতিম হয়ে গেল। ওদের ভবিষ্যৎ কী হবে? আমি তো একা মানুষ, কাকে ধরব? আমরা সাধারণ মানুষ, তবু সুখে ছিলাম। স্বামী পরিশ্রম করে সংসার চালাত। এখন সব শেষ। আমি শুধু চাই, আমার বাচ্চারা যেন পথে না পড়ে।
আবুল কালামের বোন সেলিনা বেগম বলেন, আমার ভাইর মতো মানুষ এই দুনিয়ায় নাই। সে কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি কখনো। এমন ভালো মানুষের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।
শরীয়তপুরের নড়িয়ার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের জলিল চোকদার ও হনুফা বেগম দম্পতির ছেলে আবুল কালাম চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে ভাইদের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন। ২০ বছর আগে তাঁর বাবা ও মা মারা যান। এরপর তিনি বড় হন বড় ভাই ও বোনদের কাছে।
সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় যান আবুল কালাম। সেখান থেকে ফিরে ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। দাম্পত্য জীবনে তাঁদের পাঁচ বছরের এক ছেলে ও তিন বছর বয়সী এক মেয়েসন্তান রয়েছে। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে আবুল কালাম নারায়ণগঞ্জে বসবাস করতেন এবং ঢাকার মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কাজ করতেন।
সোমবার (২৭ অক্টোবর) সকাল ৯টার দিকে মোক্তারের চর ইউনিয়নের পূর্ব পোড়াগাছা ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা মাঠে জানাজা শেষে নড়িয়া বাজার জামে মসজিদের গণকবরস্থানে দাফন করা হয় আবুল কালাম আজাদকে। দাফনের সময় কান্নার স্রোতে ভেসে যায় মাদরাসা মাঠ। গ্রামের মানুষও কাঁদে নিজের মতো করে—কেউ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে, কেউ আবার বুক চাপড়ে আহাজারি করে।
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল কাইয়ুম খান বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী নিহতের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের পাশে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।
এদিকে স্বজন ও এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, মেট্রোরেল প্রকল্পে নিরাপত্তার ঘাটতি ও অবহেলার কারণেই এই প্রাণহানি ঘটেছে। তারা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও নিহত পরিবারের জন্য স্থায়ী সরকারি সহায়তা প্রদানের জোর দাবি জানিয়েছেন।
এনআই
Monday 3 November 2025
somoyerkonthosor - 7 days ago
