বাংলাদেশে আজও কন্যাসন্তান জন্ম নেওয়া মানেই চাপা এক শঙ্কা। কন্যাসন্তান জন্মালে অনেক ঘরেই নেমে আসে নীরবতা। এর প্রধান কারণ হচ্ছে—কন্যার নিরাপত্তা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, বাল্যবিবাহ এবং যৌতুকপ্রথা। দেশের অনেক জেলায় ইভটিজিংয়ের পাশাপাশি যৌতুকের প্রথা ভয়ানক প্রভাব বিস্তার করে আছে। ফলে বাবা-মায়ের ভেতরে তৈরি হতে থাকে একটি হিসাব—কত টাকা লাগবে? কত দ্রুত মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যায়। এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে তাদের মাথায়।
যৌতুকের জন্য অনেক পরিবার শুরু থেকেই অর্থ জমাতে থাকে। কেউ হয়তো প্রতিদিনের বাজার থেকে ১০ টাকা বাঁচিয়ে এক জায়গায় জমা রাখছেন। কেউ কেউ নিজের বিয়ের গয়না খুলে মেয়ের জন্য রেখে দেন। এমনও মা আছেন, যিনি নিজের চিকিৎসার খরচ মেয়ের বিয়ের সঞ্চয়ে ব্যয় করছেন।
এমনটি শুধু সাধারণ বা গরিব পরিবারেই নয়—অনেক শিক্ষিত পরিবারেও এ বাস্তবতা বিদ্যমান। শিক্ষা, সৌন্দর্য কিংবা চারিত্রিক গুণ নয়, মেয়ের মূল্য নির্ধারিত হয় বাবা-মা যৌতুক দিতে পারবেন কি না, সেটা দিয়ে। যৌতুকের অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক পরিবার নিস্ব হয়েছে।
শাবানা বেগমের (ছদ্মনাম) দুটি কন্যাসন্তান। বড় মেয়ের বয়স ১০ বছরের বেশি। ছোট মেয়েটি এখনো শিশু। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সংগ্রামী নারী। মা-বাবা না থাকায় জীবনের প্রতিটি ধাপে তাকে লড়াই করতে হয়েছে একা। সে লড়াই তাকে নিয়ে গেছে ঢাকা শহরে, যেখানে তিনি চাকরি করে নিজের ও ভবিষ্যতের জন্য সামান্য হলেও কিছু টাকা জমাতে সক্ষম হন।
বিয়ের সময় শাবানা বেগম নিজের কষ্টে উপার্জিত সব অর্থ বরপক্ষকে যৌতুক হিসেবে দিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘আমার মা-বাবা নেই। তাই যা ইনকাম করেছি, সবই বরের পরিবারকে দিয়েছি। যাতে আমি সেখানে একটু ভালোভাবে থাকতে পারি।’ তার ভাষায়, যৌতুক না দিলে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া অনেক কঠিন। সাধারণ পরিবারের মেয়েদের জন্য তো যৌতুক অনিবার্য বাস্তবতা।
বর্তমানে তার স্বামী যা আয় করেন; তা দিয়েই সংসার চালান। পাশাপাশি কিছু টাকা জমাতে চেষ্টা করেন। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। নিজের উপার্জন ও বিয়ের সময় সাথে করে আনা গয়না মেয়েদের জন্য সংরক্ষণ করে রাখছেন। তার একটাই আশা—মেয়েরা যেন ভবিষ্যতে স্বামীর বাড়িতে সুখে থাকতে পারে। সে জন্য তিনি আজও কষ্ট করছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘যৌতুকের টাকা হয়তো বড়লোকদের জন্য জোগাড় করা সহজ। আমাদের মতো পরিবারের জন্য এটি অনেক কষ্টের ব্যাপার। তবুও মেয়েদের সুখের কথা ভেবেই এই ত্যাগ স্বীকার করছি।’
সুহেদা (ছদ্মনাম) ২৩ বছর বয়সী মা। তার ঘরে দুই বছরের একটি কন্যাসন্তান। স্বামী টেক্সটাইল কারখানায় ইলেকট্রিক্যাল বিভাগে কাজ করেন। সীমিত বেতনের মধ্যেও সংসার চালানোর পাশাপাশি মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য কিছু অর্থ সঞ্চয় করছেন।
সুহেদা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি—মেয়ে জন্ম নিলে মা-বাবারা বিয়ের জন্য টাকা জমাতে শুরু করেন। বিশেষ করে যৌতুকের চাপ সামলানোর জন্যই অনেক কষ্ট সহ্য করে টাকা জমান। আমি নিজেও যৌতুকের বিরুদ্ধে। এটি কখনোই পছন্দ করি না। বাস্তবতা খুব কঠিন। সামনে কী হবে, কেউ জানে না। সমাজের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা খুব কঠিন হয়ে যায়। মা হিসেবে চাই, মেয়ের যেন ভবিষ্যতে কষ্ট না হয়।’
আরও পড়ুনপ্রবীণরা বোঝা নন, জ্ঞানের ভান্ডারছবি তুলেই আয় করছেন সেজান
ছামিউল হক (ছদ্মনাম) দিনমজুর। দুই সন্তানের বাবা। তার ঘরে ১৭ বছর বয়সী কন্যাসন্তান আছে। পরিবার নিয়ে একসময় ঢাকায় থাকতেন। স্বামী-স্ত্রী পরিশ্রম করে সংসার চালাতেন। গত এক বছর ধরে অসুস্থতার কারণে ছামিউল কোনো কাজ করতে পারেন না। বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরেছেন। সেখানেই সংসারের হাল ধরেছেন। যতটুকু পারেন, কাজ করে সংসার সামলাচ্ছেন। ঢাকায় তার স্ত্রী একাই পরিশ্রম করে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন।
ছামিউল হক বলেন, ‘মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে। বিয়ের প্রস্তাবও আসছে। আজও একটা ভালো ঘর তোলা হলো না। মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য ঠিকমতো কিছুই জমাতে পারি নাই। মেয়েকে বিয়ে দিতে গেলে যৌতুক লাগবেই। যৌতুক ছাড়া ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়া খুব কঠিন। মেয়ের মা খুব কষ্ট করেন। নিজের খরচ বাঁচিয়ে টাকা জমানোর চেষ্টা করছেন। নিজেও কাজে ফেরার চেষ্টা করছি। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।’
কবি ও প্রাবন্ধিক জাকারিয়া জাহাঙ্গীর মনে করেন, ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে যৌতুকের টাকা জোগাড় করার ভীতিটা বেশি। বিশেষ করে সাধারণ মানুষদের মধ্যে এ প্রবণতা অধিক লক্ষ্য করা যায়। মনে করা হয়, মেয়ে জন্মের পর থেকেই টাকা জোগাড় করা শুরু না করলে পরে বেগ পেতে হবে। তাদের ধারণা, মেয়েকে কম বয়সে বিয়ে দিতে পারলে ভালো পাত্র পাওয়া যাবে; অন্যদিকে যৌতুকের টাকাও কম লাগবে। ধারণাটি শুধু অশিক্ষিত বা দরিদ্র পরিবারের মধ্যেই নয়, শিক্ষিত পরিবারগুলোর মধ্যেও মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাড়তি চিন্তা দেখা যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজেও কন্যাসন্তানের বাবা। আমার স্ত্রী এখনই মাঝেমধ্যে বলে থাকেন, মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তো তোমাকে বিশেষভাবে ভাবতে দেখি না! আমার কথা হলো—মেয়েকে যোগ্য করে গড়ে তোলাটাই বাবা-মায়ের লক্ষ্য হওয়া উচিত। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিজেই গড়ে তুলতে পারবে।’
শাহেদা ফেরদৌসী বর্তমানে জামালপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক। ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত এ নারী শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। পাশাপাশি লড়ছেন ভয়াবহ ব্যাধি যৌতুকের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘আমরা ছিলাম সাত বোন। বাবা কখনো যৌতুকের কথা ভাবেননি। সামর্থের শেষ বিন্দু দিয়ে আমাদের শিক্ষিত করেছেন। আমরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল একেবারে অজপাড়াগাঁ থেকে। এতদূর আসতে পথে পথে লড়াই ছিল। ছিল অগণিত বাধা। আমরা হাল ছাড়িনি।’
একজন শিক্ষক হিসেবে শাহেদা ফেরদৌসী নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘স্কুলে আমি অসংখ্য শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবার দেখেছি; যারা যৌতুকের টাকার জন্য দিশেহারা। তাই আমরা শিক্ষকদের পক্ষ থেকে প্রতিটি ক্লাস, সভা ও অভিভাবক সমাবেশে যৌতুক ও বাল্যবিবাহের কুফল নিয়ে আলোচনা করি। আমরা শুধু পড়াই না, চেষ্টা করি সমাজ বদলেরও।’
তিনি বলেন, ‘বাল্যবিবাহ যৌতুকের মূল কারণ। আমাদের স্কুল থেকে এখন পর্যন্ত অনেক বিয়ে বন্ধ করেছি। আমি বিশ্বাস করি, একজন মেয়ে যদি শিক্ষাগ্রহণের পূর্ণ সুযোগ পায়, তবে সে নিজেই যৌতুকের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে। সমাজের জন্য পরিবর্তন আনতে পারবে।’
শাহেদা ফেরদৌসী এটিও স্বীকার করেন, ‘এখনো বহু অভিভাবক মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন—কীভাবে যৌতুক দেবেন। কীভাবে মেয়েকে সংসারে টিকিয়ে রাখবেন। এ লড়াই সহজ নয়। তবে আগের চেয়ে পরিস্থিতি উন্নত হচ্ছে। সচেতনতা বাড়ছে। মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে শিখছে। যৌতুক কোনো সমাধান নয়, এটি সামাজিক অভিশাপ।’
এসইউ/এএসএম
				Tuesday 4 November 2025			
						
		