তীব্র খাদ্য সংকট, চরম দুর্নীতি, দুর্বল চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা এই সব মানবিক সংকটের উদাহরণ যেন আফ্রিকাতেই দেখা যায়। অথচ এই মহাদেশই খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ। তেল-গ্যাসের বড় রিজার্ভ, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ স্বর্ণের মজুদ, প্রাচীন ক্রোমিয়ামের বিশাল ভান্ডার সবই আফ্রিকার বুকেই। কিন্তু পিঠে স্বর্ণের পাহাড় থাকলেও মানুষের পকেটে দারিদ্র্য।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ আফ্রিকা প্রায় এক কোটি ১৭ লাখ বর্গ মাইলে বিস্তৃত। এখানে ৫৪টি রাষ্ট্রে প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ বসবাস করছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী ২০২৫ সালে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশ আফ্রিকার দক্ষিণ সুদান, যেখানে মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ২৫১ ডলার এবং প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ঋণাত্মক।
এ অঞ্চলের বহু রাষ্ট্রের দারিদ্র্যের মূল কারণ হলো ইতিহাস, রাজনীতি ও দুর্বল প্রতিষ্ঠান। উপনিবেশিক শক্তি যখন আফ্রিকার মানচিত্র আঁকছিল, তখন জাতিগোষ্ঠী, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবকে উপেক্ষা করে কৃত্রিম সীমানা টানা হয়। স্বাধীনতা আসলেও গভীর ক্ষত সারেনি। প্রশাসন দুর্বল, আস্থার সংকট, রাজনীতি অস্থিতিশীল, বিনিয়োগ আসে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল কম।
খনিজ সম্পদ আফ্রিকার জন্য কখনও কখনও অভিশাপে পরিণত হয়েছে। হঠাৎ কোনও খনিজের সন্ধান মিললেই অর্থনীতি নির্ভর হয়ে যায় সেই খাতের ওপর, কৃষি ও শিল্প খাত পিছিয়ে পড়ে। তেলের খনি, হীরা ও কোবাল্ট যেমন অর্থ আনে, তেমনি অস্ত্র, মিলিশিয়া ও সংঘাতও বয়ে আনে। গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো এই বাস্তবতার বড় উদাহরণ। সরকার ও বিদেশি বিনিয়োগকারীর পরিবর্তনের মধ্যেও স্থানীয় মানুষের জীবন খুব কম বদলায়।
কঙ্গো, নাইজেরিয়া ও মোজাম্বিকের মতো দেশগুলোতে হীরা, স্বর্ণ, কোবাল্টের বিপুল ভান্ডার থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের জীবন প্রায় অপরিবর্তিত। বড় খনি এলাকা থেকে অর্থ আসে, কিন্তু শিক্ষা, হাসপাতাল, রাস্তা বা অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়ন অনুপস্থিত।
দুর্নীতি ও অর্থপাচার দেশগুলোর উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী আফ্রিকা থেকে বছরে প্রায় ৮৯ বিলিয়ন ডলার অবৈধ আর্থিক প্রবাহ বাহিরে চলে যায়। বিদ্যুৎ, পানি ও অবকাঠামো প্রকল্পে টাকা চলে যায়, যেমন মোজাম্বিকের টুনা বন্ড কেলেঙ্কারি।
ঋণগ্রহণের সময় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বন্ধক বা ভবিষ্যৎ আয়ের দাবিদার তৈরি হয়। নাইজেরিয়ায় তেল, কঙ্গোতে কোবাল্ট খনি, কেনিয়ায় মোমবাসা বন্দর-সবই বিদেশি দাতাদের সঙ্গে চুক্তির শিকার হয়।
জলবায়ুর প্রভাবও মারাত্মক। সাহারা অঞ্চলে দীর্ঘ খরা, মধ্য আফ্রিকায় অতিবৃষ্টি ও বন্যা সবই কৃষি উৎপাদনকে বিপর্যস্ত করছে। ফসল ধ্বংস, জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি ও পানি ব্যবস্থাপনার অভাব দারিদ্র্য বাড়াচ্ছে।
দারিদ্র্যের কারণ শুধুই অর্থনৈতিক নয়। এটি ইতিহাসের প্রভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, দুর্নীতি ও ঋণের জটিলতার মিলিত ফল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আফ্রিকার স্থায়ী উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠান, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক শাসন, স্থানীয় পর্যায়ে কার্যকর আইন এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা। শুধু সম্পদ নয়, নীতি, আইন এবং মানবিক উন্নয়ন মিলেই টেকসই সমৃদ্ধি সম্ভব।
এবি
Sunday 2 November 2025
⁞
